পর্চা বা খতিয়ান তুলতে সমস্যা হয় কেন? জেনে নিন কারণ, সমাধান ও পরামর্শ
খতিয়ান বা পর্চা তুলতে সমস্যা হয় কেন? জেনে নিন কারণ, সমাধান ও পরামর্শ
<<জমি সংক্রান্ত সমস্যা ও সমাধান>>
বাংলাদেশে জমির মালিকানা নিশ্চিত করার জন্য খতিয়ান বা পর্চা উত্তোলন
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি শুধুমাত্র মালিকানার প্রমাণ নয়, বরং ভবিষ্যতে
বিক্রি, জমি বণ্টন বা মামলা-মোকদ্দমা সম্পর্কেও নির্ধারণ করে দেয়। তবে বাস্তবে দেখা
যায়, অনেকেই খতিয়ান উত্তোলনে সমস্যায় পড়েন। এই সমস্যা কখনো তথ্যগত, কখনো প্রশাসনিক
আবার কখনো প্রযুক্তিগত হতে পারে।
আজকের এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করবো কেন খতিয়ান বা পর্চা তুলতে সমস্যা
হয় এবং সেই সমস্যাগুলোর সহজ সমাধান।
তথ্যের অসঙ্গতি ও ঘাটতি
<<জমি সংক্রান্ত অনলাইনে কি কি সেবা পাওয়া যায়>>
সমস্যা:
অনেক সময় আবেদনকারী জমির সঠিক দাগ নম্বর, খতিয়ান নম্বর, মৌজা বা
মালিকের নাম দিতে পারেন না। আবার দলিল অনুযায়ী তথ্য ও বাস্তব তথ্যের মধ্যে মিল না
থাকলে আবেদন বাতিল হয়।
সমাধান:
দলিল, পর্চা ও অন্যান্য নথি ভালোভাবে যাচাই করুন।
সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে গিয়ে রেকর্ডপত্র যাচাই করে নিন।
প্রয়োজনে জরিপ অফিস বা তহসিল অফিস থেকে সহায়তা নিন।
পুরনো বা ভুল দলিল
<<ভূমি ও ভূমি সংক্রান্ত তথ্য>>
সমস্যা:
অনেক সময় জমির দলিল পুরনো, অপঠনযোগ্য বা তাতে ভুল থাকে যেমন ভুল মালিকের
নাম, ভুল দাগ নম্বর, সীমানার অস্পষ্টতা ইত্যাদি।
সমাধান:
পুরনো দলিল বা ভুল দলিলের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আইনজীবীর সহায়তা নিন।
রেকর্ড সংশোধন করার জন্য ভূমি অফিসে আবেদন করুন।
নামজারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিক তথ্য প্রতিষ্ঠা করুন।
ওয়ারিশ সনদ ও উত্তরাধিকার সমস্যা
সমস্যা:
যদি জমির বর্তমান মালিক ও উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিরোধ থাকে বা ওয়ারিশ
সনদে অস্পষ্টতা থাকে, তাহলে খতিয়ান উত্তোলন আটকে যায়।
সমাধান:
সঠিক ওয়ারিশ সনদ সংগ্রহ করুন (ইউপি চেয়ারম্যান বা পৌরসভা থেকে)।
সকল উত্তরাধিকারীর স্বীকৃতি নিশ্চিত করুন।
সম্মতিমূলক নামজারি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করুন।
প্রশাসনিক ত্রুটি ও দীর্ঘসূত্রতা
<<জমি সংক্রান্ত বিভিন্ন ডকুমেন্ট পরিচিতি>>
সমস্যা:
ভূমি অফিসে আবেদন প্রক্রিয়াকরণে বিলম্ব, দুর্নীতি, বা অফিসিয়াল ভুলের
কারণে খতিয়ান উত্তোলন ঝুলে যায়।
সমাধান:
আবেদনের কপি ও রিসিভ সংরক্ষণ করুন।
নিয়মিত যোগাযোগ করুন সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার
সঙ্গে।
ভূমি হেল্পলাইন (১৬১২২) এ অভিযোগ করুন।
অনলাইন আবেদন ও প্রযুক্তিগত সমস্যা
সমস্যা:
বর্তমানে অধিকাংশ খতিয়ান উত্তোলন অনলাইন আবেদনভিত্তিক। সার্ভার সমস্যা,
ভুল তথ্য এন্ট্রি, কিংবা পেমেন্ট জটিলতা এই প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
সমাধান:
আবেদন করার সময় তথ্য সাবধানে দিন।
পেমেন্ট সফল হয়েছে কিনা তা যাচাই করে সংরক্ষণ করুন।
অনলাইন সমস্যা হলে স্থানীয় ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (UDC) থেকে সহায়তা
নিন।
মালিকানা বিতর্ক বা মামলা চলমান থাকা
<<জমির দলিল সংক্রান্ত তথ্য>>
সমস্যা:
জমি যদি কোনো মামলা-মোকদ্দমার আওতাধীন থাকে অথবা মালিকানা নিয়ে বিরোধ
থাকে, তাহলে খতিয়ান উত্তোলন স্থগিত রাখা হয়।
সমাধান:
আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলে প্রথমে সেটি নিষ্পত্তি করুন।
মালিকানা নিশ্চিত করতে রেকর্ডপত্র ও প্রমাণপত্র সংগ্রহ করুন।
প্রয়োজনে আইনজীবীর পরামর্শ নিন।
আবেদন ফরমে ভুল
<<জমি সংক্রান্ত নতুন আইন>>
সমস্যা:
অনেকে খতিয়ান আবেদন ফরম পূরণের সময় ভুল করে বসেন—যেমন ভুল মৌজা কোড,
মৌজা নাম, কিংবা ভুল মালিকের নাম।
সমাধান:
আবেদন করার আগে দু’বার যাচাই করুন।
ভুলের ক্ষেত্রে সংশোধন করে পুনরায় আবেদন দিন।
অফিস কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়ে সহায়তা নিন।
ভূমি জরিপ প্রক্রিয়া ও প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত ব্যাখ্যা
<<ভূমির মালিকানা সংক্রান্ত তথ্য>>
বাংলাদেশে জমির মালিকানা নির্ধারণ, খতিয়ান প্রস্তুত ও রেকর্ড হালনাগাদের
জন্য সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয় ভূমি জরিপ (Settlement Survey)। এই জরিপ একটি সুপরিকল্পিত
ধাপে ধাপে পরিচালিত প্রক্রিয়া, যার প্রতিটি স্তরে নির্দিষ্ট কাজ ও দায়িত্ব থাকে।
এখানে ভূমি জরিপের ১০টি ধাপ ধারাবাহিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
১.বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও জনসচেতনতা:
জরিপ শুরুর পূর্বে ১৯৫০ সালের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৪(১) ধারা
এবং বঙ্গীয় জরিপ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার অফিসার
জরিপের শুরুর ঘোষণা দিয়ে ৫ ও ৭ ধারার নোটিশ ইস্যু করেন।
কী কী করা হয়:
এলাকায় মাইকিং, পোস্টার, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রচার।
ভূমি মালিকদেরকে নিজ নিজ জমির সীমানা (আইল) চিহ্নিত করে রাখতে বলা
হয়।
সমস্ত দলিল ও কাগজপত্র হালনাগাদ করে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
২. ট্রাভার্স (Traverse):
নতুনভাবে মৌজার নকশা তৈরি করতে হলে মৌজায় কাঠামোগত জরিপের জন্য “ট্রাভার্স” করা হয়। এটি
মূলত মৌজার বাইরের পরিমাপ কাঠামো।
মূল দায়িত্ব:
সার্ভেয়ারের নেতৃত্বে জরিপ দল এই কাজটি করে।
এই ধাপ শেষে পি-৭০ সিটে মৌজার নতুন ম্যাপ প্রস্তুত করা হয়।
তবে, যদি ব্লু-প্রিন্ট (পুরাতন নকশা) অনুযায়ী জরিপ হয়, তখন ট্রাভার্সের
প্রয়োজন হয় না।
৩. কিস্তোয়ার:
এ ধাপে প্রতিটি খণ্ড জমির সঠিক পরিমাপ করে তা মৌজার নকশায় প্রতিফলন
ঘটানো হয়।
কাজের বিবরণ:
আমিনরা জমি পরিমাপ করে নতুন নকশায় অঙ্কন করেন বা পুরাতন নকশা সংশোধন
করেন।
এই কাজ হয় উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার (কানুনগো)-এর তত্ত্বাবধানে।
৪. খানাপুরি:
এটি জরিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোর একটি, যেখানে জমির দাগ অনুযায়ী
মালিকের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
কী করা হয়:
জমিতে গিয়ে প্রতিটি দাগ নম্বর অনুযায়ী মালিকানা, দখল, ঠিকানা ও দলিল
যাচাই করে তথ্য রেকর্ডে লেখা হয়।
ভূমি মালিকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করতে হয়।
তত্ত্বাবধান: উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার (কানুনগো)
৫. বুঝারত (মাঠ পর্চা বিতরণ):
খানাপুরি শেষে তৈরি খতিয়ান বা পর্চা মালিকদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এটিকে
“মাঠ পর্চা” বলা হয়।
প্রক্রিয়া:
তারিখ জানিয়ে নোটিশ, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও মাইকিং করা হয়।
বিতরণকৃত পর্চায় ভুল থাকলে মালিকরা “বিবাদ ফরম” পূরণ করে জমা
দিতে পারেন।
শুনানি ও বিবাদ নিষ্পত্তি করেন: হল্কা অফিসার (উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট
অফিসার)
৬. খানাপুরি ও বুঝারত একত্রে (যদি ব্লু-প্রিন্টে জরিপ হয়):
যেসব মৌজায় পুরাতন ব্লু-প্রিন্ট সিটে জরিপ হয়, সেখানে খানাপুরি ও বুঝারত
একসাথে করা হয়।
দায়িত্বপ্রাপ্তরা:
সরদার আমিন
হল্কা অফিসার (কানুনগো/ক্যাডাস্ট্রাল সার্কেল অফিসার)
৭. তসদিক (Attestation):
মাঠ পর্চার তথ্য যাচাই ও সত্যায়নের প্রক্রিয়া হচ্ছে “তসদিক”।
কী করা হয়:
কাগজপত্র যাচাই করে প্রতিটি বুঝারত খতিয়ান সত্যায়ন করা হয়।
পর্চা বা নকশায় আপত্তি থাকলে মালিকরা আবার বিবাদ ফরম জমা দিতে পারেন।
এই পর্চা-ই প্রথম আইনগত ভিত্তির দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।
দায়িত্বপ্রাপ্ত: কানুনগো/রাজস্ব অফিসার
৮. খসড়া প্রকাশনা (ডিপি) ও আপত্তি দায়ের:
তসদিকের পরে তৈরি খতিয়ান ডিপি (Draft Publication) আকারে প্রকাশ করা
হয়। এটি সাধারণ জনগণের দেখার জন্য ৩০ দিন উন্মুক্ত রাখা হয়।
ভূমি মালিকদের করণীয়:
নিজ নামের অক্ষর অনুযায়ী ক্যাম্প অফিসে উপস্থিত হয়ে ডিপি নম্বর সংগ্রহ
করা।
কোনো আপত্তি থাকলে ১০ টাকার কোর্ট ফি দিয়ে নির্ধারিত ফরমে আপত্তি জানানো।
দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার: উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার
৯. আপত্তি শুনানি:
ডিপিতে দাখিলকৃত আপত্তিগুলোর শুনানি করা হয় এবং সেগুলোর নিষ্পত্তি
করা হয়।
প্রক্রিয়া:
পক্ষগণকে নির্দিষ্ট তারিখে শুনানির জন্য ডাকা হয়।
শুনানির ভিত্তিতে রায় কেস রেকর্ডে লিপিবদ্ধ করা হয়।
প্রয়োজনীয় হলে খতিয়ানে সংশোধনী আনা হয়।
শুনানি গ্রহণ করেন: সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার / উপজেলা সেটেলমেন্ট
অফিসার
আপিল শুনানি:
আপত্তি শুনানির রায়ে অসন্তুষ্ট পক্ষ বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব বিধিমালার
৩১ বিধি অনুযায়ী আপিল করতে পারেন।
কীভাবে আপিল করবেন:
নির্ধারিত কোর্ট ফি ও কার্টিজ পেপারসহ আপিল আবেদন জমা দিতে হয়।
নোটিশ অনুযায়ী আপিল শুনানি হয় এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়।
শুনানি গ্রহণ করেন: সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার / চার্জ অফিসার / জেলা
সেটেলমেন্ট অফিসার
সহায়তার জন্য যোগাযোগ
জমি সংক্রান্ত তথ্য জানতে চাই
ভূমি হটলাইন: ১৬১২২
অনলাইন অভিযোগ:
hotline.land.gov.bd
FAQ (প্রশ্ন ও উত্তর)
১. খতিয়ান তুলতে কত দিন লাগে?
উত্তর: যদি সব তথ্য সঠিক থাকে, সাধারণত ৭-২১ কার্যদিবসের মধ্যে খতিয়ান
উত্তোলন সম্পন্ন হয়।
২. খতিয়ান উত্তোলনের জন্য অনলাইনে কিভাবে আবেদন করব?
উত্তর: land.gov.bd ওয়েবসাইটে গিয়ে নির্ধারিত ফরম পূরণ ও পেমেন্ট করে
আবেদন করতে হবে।
৩. খতিয়ান উত্তোলনে টাকা লাগে কি?
উত্তর: হ্যাঁ, নির্ধারিত সরকারী ফি দিতে হয়। অনলাইনে পেমেন্ট করতে
হয় বিকাশ/নগদ/কার্ডের মাধ্যমে।
৪. দলিলে ভুল থাকলে খতিয়ান তোলা যাবে?
উত্তর: দলিলে ভুল থাকলে প্রথমে ভুল সংশোধন করতে হবে। সংশোধিত দলিল
দিয়ে খতিয়ান তোলা সম্ভব।
৫. নামজারি ছাড়া খতিয়ান তোলা যাবে?
উত্তর: না, নামজারি না থাকলে মালিকানা স্বীকৃতি হয় না, ফলে খতিয়ান
উত্তোলন সম্ভব হয় না।
উপসংহার
খতিয়ান বা পর্চা উত্তোলন একটি দায়িত্বপূর্ণ এবং প্রক্রিয়াভিত্তিক কাজ। সঠিক দলিল, তথ্য ও সরকারি নির্দেশনা অনুসরণ করলে এই প্রক্রিয়া সহজেই সম্পন্ন করা যায়। অনিয়ম, ভুল তথ্য ও অবহেলার কারণে অনেকেই বছরের পর বছর হয়রানির শিকার হন। তাই, নিজেই সচেতন হোন, সরকারি সহযোগিতা নিন এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করুন।