লাভ হাট: যেখানে প্রেমের অনুমতি দেয় পরিবার
লাভ হাট: যেখানে প্রেমের অনুমতি দেয় পরিবার
যেখানে শহুরে সভ্যতা প্রেমকে আড়ালে রাখে, যেখানে সমাজের চোখরাঙানি প্রেমিক-প্রেমিকাদের আত্মগোপনে বাধ্য করে, সেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি ছোট্ট দ্বীপে প্রেমের বুনিয়াদ গাঁথা হয়েছে খোলা আকাশের নিচে, সবুজ গাছের ছায়ায়, একঝাঁক নরম বাতাসের আলিঙ্গনে। এই দ্বীপে প্রেম লুকিয়ে নেই, নেই লজ্জা বা ভয়। বরং, এখানে প্রেমিকদের জন্য বানানো হয় 'লাভ হাট'—ভালবাসার কুঁড়েঘর। এই গল্প শুধু কুঁড়েঘরের নয়, এই গল্প ভালোবাসার সংস্কৃতির, এই গল্প এক অসাধারণ মানবিক উপলব্ধির, যেখানে প্রেমই জীবন, যৌনতা নয় বেহায়াপনা, বরং আত্মিক বন্ধনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চলুন, আজ আমরা ডুব দিই এই দ্বীপের প্রেমপুরাণে—কম্বোডিয়ার 'লাভ হাট'-এর অন্তরালে থাকা মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, এবং তাদের ব্যতিক্রমী বিশ্বাসে। ...(কম্বোডিয়ার 'লাভ হাট :যেখানে প্রেমের অনুমতি দেয় পরিবার)........
ক্রেয়াং জনগোষ্ঠীর পরিচয়
কম্বোডিয়ার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে ছোট্ট একটি দ্বীপ, যেখানে ক্রেয়াং (Kreung) নামক এক প্রাচীন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। সংখ্যায় তাঁরা খুব বেশি নয়, কিন্তু সংস্কৃতিতে তারা সমৃদ্ধ, চিন্তায় আধুনিক, আর হৃদয়ে উদার। তারা নিজেদের ছোট্ট গ্রামে থাকে, যাকে ঘিরে রয়েছে বিস্তৃত জলাশয়, কাঁকড়াবিছা ভরা ঘাসবন, আর ছোট ছোট কাঁচা রাস্তাঘাট।
ক্রেয়াংদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব স্পষ্ট: বিয়ের আগে ভালবাসা জরুরি, আর সেই ভালবাসা যদি নিখাদ হয় তবে বিয়ের ভিত মজবুত হবে। কিন্তু প্রেম তো একদিনে তৈরি হয় না। তার জন্য সময় লাগে, দরকার হয় সঙ্গ, নিরিবিলি সময়। তাই, মেয়েরা যখন কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেয়, তখন থেকেই তাদের জীবনের সঙ্গী খোঁজার অধিকার পায়।
লাভ হাটের সূচনা
একটি কিশোরী যখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়, তখন তার বাবা-মা একটি ছোট্ট মাটির ঘর বানিয়ে দেন বাড়ির উঠোনের এক কোণে, বা গ্রামের নিরিবিলি কোন জলাশয়ের ধারে। সেই কুঁড়েঘরকেই বলে ‘লাভ হাট’। ঘরটি খুবই সাধারণ—মাটির দেয়াল, পাটকাঠির চাল, বাঁশের মাচা, মাঝে একটি খাটের মতো কাঠামো। তাতে বিছানো থাকে চটের পাটি বা মোটা কাপড়। জানালা থাকে দু’টো, আর একটি কাঠের দরজা। কিন্তু এই ঘরই সেই স্থান, যেখানে প্রেমিকেরা মিলিত হয়। এখানে প্রেমিক-প্রেমিকা একসঙ্গে সময় কাটায়, কথা বলে, হাসে, মাঝে মাঝে গান গায়, আর কখনো কখনো গা ঘেঁষে বসে ভালোবাসার আলিঙ্গনে নিজেকে খুঁজে পায়।
অভিভাবকের ভূমিকায় মানবিকতা
এই সংস্কৃতির সবচেয়ে ব্যতিক্রমী দিক হল—অভিভাবকের সহানুভূতিশীল সহযোগিতা। একেবারে উলটো ছবি শহরের, যেখানে মেয়ের প্রেম মানেই বাবা-মার কপালে ভাঁজ পড়ে। কিন্তু ক্রেয়াং অভিভাবকেরা নিজেরা হাত দিয়ে বানান মেয়ের লাভ হাট। তাঁরা বলেন, "আমরা যদি না বুঝি, তাহলে মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে। সে যেন নিজের সিদ্ধান্তে সঠিক পথ পায়, তার জন্য আমরা এই আশ্রয় তৈরি করি।"
এই সংস্কৃতিতে বাবা-মা কখনোই সন্তানদের প্রেমকে 'পাপ' বা 'লজ্জার বিষয়' বলে মনে করেন না। বরং তাঁরা বিশ্বাস করেন, মেয়েকে স্বাধীনতা দিলে সে নিজেই তার জন্য সঠিক সঙ্গী বেছে নেবে। আর এই বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়াটিই 'লিভ-ইন'।
লিভ-ইনের ছন্দ
মেয়েটি তার লাভ হাটে রাতে অবস্থান করে। সন্ধে নামলেই দ্বীপের চারপাশ জ্বলে ওঠে মোমবাতির আলোয়। কোনও বিদ্যুৎ নেই এখানে, আছে কুয়াশার ভেতরে মায়াবী চাঁদের আলো, আর প্রেমিক হৃদয়ের উষ্ণতা। প্রতি রাতে ভিন্ন ভিন্ন প্রেমিক আসতে পারে—এই সংস্কৃতিতে তা অস্বাভাবিক নয়। মেয়েটি নিজের মন অনুযায়ী কার সঙ্গে সময় কাটাবে তা বেছে নেয়।
যদি কোনও একজন প্রেমিকের সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তবে সে ক্রমে অন্যদের দূরে সরিয়ে দেয়। কিছুদিনের মধ্যেই যদি বোঝে যে সম্পর্ক সৎ ও স্থিতিশীল, তবে পরিবার দুইজনের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু যদি সম্পর্ক ভেঙে যায়, তবে সমস্যা নেই। আরেকজন প্রেমিক এল, নতুন করে প্রেম শুরু হল, নতুন আশায় ঘর আলো করে উঠল।
যৌনতা বনাম ভালবাসা
এই লাভ হাট নিয়ে অনেকের মনেই একরকম ধোঁয়াশা থাকে। কেউ বলেন, এটি যেন অনুমোদিত যৌনতার আশ্রয়। কিন্তু ক্রেয়াংরা যৌনতা মানেই দেহজ সান্নিধ্য মনে করেন না। তাদের মতে, প্রেম মানেই আত্মার টান। যৌনতা সেখানে শুধু একটি উপাদান, যাচাই করার উপায়—অবজ্ঞার নয়, অতি মূল্যবান এক অনুভবের অংশ।
এই গ্রামে কোনওদিন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। কোনও নারী কু-মন্তব্যের শিকার হননি। কারণ এখানকার পুরুষরা নারীর শরীরকে শুধু আকর্ষণের বস্তু হিসেবে দেখেন না, বরং শ্রদ্ধা করেন। তাঁরা জানেন, সম্মান দিয়েই পাওয়া যায় ভালবাসা।
সমাজে নারীর অবস্থান
ক্রেয়াং সমাজে নারীরা পুরুষদের সমান অধিকার ভোগ করে। তাঁদের সিদ্ধান্তকেই অগ্রাধিকার দেয় পরিবার। এমনকি বিয়ের পরেও নারীরা চাইলেই সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারেন। তাঁদের মতামতই চূড়ান্ত। সমাজ তাদের দোষ দেয় না, বরং পাশে দাঁড়ায়। পুরুষরাও নিজের ভুল বুঝলে ফিরে যায় নিজের সংসারে, নয়তো নীরবে মেনে নেয় বিচ্ছেদ। এমন উদাহরণ আধুনিক সমাজে বিরল। ...(কম্বোডিয়ার 'লাভ হাট :যেখানে প্রেমের অনুমতি দেয় পরিবার)
পর্যটকের চোখে প্রেমের দ্বীপ
প্রতি বছর কিছু পর্যটক এই দ্বীপে আসেন। তাঁরা দেখে যান লাভ হাটের সারি, নদীর ধারে কুঁড়েঘরের স্তব্ধতা, সন্ধ্যার আলোর দীপ্তি, আর মেয়েদের চোখের গভীরে থাকা আত্মবিশ্বাস। অনেকে বলেন, এখানে প্রেম যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়া শিশিরবিন্দুর মতো—নরম, বিশুদ্ধ, এবং জীবনের ছোঁয়ায় সজীব।
পর্যটকেরা বলেন, রাতের দ্বীপ যেন এক প্রেমপুরী। আলোছায়ার মধ্যে প্রেমিক যুগল একে অপরের হাত ধরে বসে থাকে, কেউ গান করে, কেউ কবিতা পড়ে, কেউ শুধু চুপ করে বসে থাকে। শব্দহীনতাই এখানে ভাষা, নিঃশব্দতাই প্রেমের প্রকাশ।
উপসংহার
কম্বোডিয়ার একটি ছোট্ট দ্বীপে গড়ে উঠেছে এক ব্যতিক্রমী প্রেম সংস্কৃতি। যেখানে লিভ-ইন মান্যতা পায়, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য তৈরি হয় ভালোবাসার ঘর, যেখানে নারী ও পুরুষ সমান মর্যাদা নিয়ে একে অপরকে গ্রহণ করে। এই গল্পটি বাস্তব,ক্রেয়াং জনগোষ্ঠীর জন্য,,
...(কম্বোডিয়ার 'লাভ হাট :যেখানে প্রেমের অনুমতি দেয় পরিবার)...