দাদা-দাদির জীবিত অবস্থায় বাবা-মা মারা গেলে নাতি-নাতনির সম্পত্তির অধিকার পাবে কি
নাতি-নাতনিরা কি দাদার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে? মুসলিম উত্তরাধিকার
আইনে বিস্তারিত বিশ্লেষণ
বাংলাদেশে মুসলিম উত্তরাধিকার আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর
বিষয়, বিশেষ করে যখন প্রশ্ন উঠে—“দাদা-দাদি বা নানা-নানি জীবিত অবস্থায় যদি বাবা-মা
মারা যান, তাহলে নাতি-নাতনিরা কি দাদার সম্পত্তির ওয়ারিশ (Waris) হবে?”
এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, কারণ এটি ইসলামি শরিয়াহ ও বাংলাদেশে প্রচলিত
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। নিচে বিষয়টি ধাপে ধাপে আলোচনা করা হলো।
মুসলিম পারিবারিক আইন ও উত্তরাধিকার কাঠামো
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, একজন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে তার
সম্পত্তি স্বাভাবিকভাবে তার জীবিত উত্তরাধিকারীদের মধ্যে শরিয়াহ অনুযায়ী বণ্টন হয়।
এই উত্তরাধিকারীরা হতে পারেন:
সন্তান
স্ত্রী বা স্বামী
পিতা-মাতা
ভাই-বোন
নাতি-নাতনি (বিশেষ ক্ষেত্রে)
তবে উত্তরাধিকার পাওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো—ব্যক্তির
মৃত্যুর সময় সেই ওয়ারিশ জীবিত থাকতে হবে।
নাতি-নাতনির অধিকার ও ১৯৬১ সালের আইন
বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ সালের ৪ ধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ
ব্যতিক্রম রাখা হয়েছে। সেই ধারা অনুযায়ী:
যদি কোনো ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে তার কোনো সন্তান মৃত্যুবরণ করে এবং
সেই মৃত সন্তানের সন্তান (অর্থাৎ নাতি-নাতনি) জীবিত থাকে, তাহলে সেই নাতি-নাতনি তাদের
পিতার অংশ গ্রহণ করতে পারবে, যতটুকু অংশ সে পেত যদি সে জীবিত থাকতো।
এই ধারার মাধ্যমে যা বোঝায়:
দাদা জীবিত থাকাকালীন, তার সন্তান (অর্থাৎ নাতির বাবা) যদি মারা যান,
এবং পরে দাদা মারা যান,
তাহলে ওই নাতি বা নাতনি তাদের বাবার প্রাপ্য অংশ পাবে, ঠিক যেন বাবা
জীবিত থাকতেন।
এটি একটি বিশেষ আইনগত সুবিধা যা এতিম নাতি-নাতনিদের অধিকার নিশ্চিত
করে।
উইলের প্রভাব
ইসলামে একজন মুসলমান তার মোট সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত উইল করতে
পারেন। যদি দাদা তার জীবদ্দশায় উইল করে যান যে তার নাতি-নাতনিদের নির্দিষ্ট অংশ প্রদান
করা হবে, তাহলে সেই অংশ তারা পাবে—শরিয়াহ ও আইন দুই অনুযায়ীই।
তবে যদি কোনো উইল না থাকে, এবং ১৯৬১ সালের ৪ ধারা কার্যকর না হয় (যেমন:
দাদা-মৃত সন্তানের ছেলে নেই বা নারী উত্তরাধিকার অগ্রাধিকার পায় না), তাহলে ওই নাতি-নাতনিরা
সরাসরি ওয়ারিশ হিসেবে বিবেচিত হবে না।
পৈতৃক বনাম স্ব-অর্জিত সম্পত্তি
অনেকেই মনে করেন, পৈতৃক সম্পত্তিতে নাতিদের জন্মগত অধিকার রয়েছে। এটি
আংশিকভাবে সত্য:
পৈতৃক সম্পত্তি: যদি দাদা তার বাবার (অর্থাৎ নাতিদের পরদাদা) কাছ থেকে
সম্পত্তি পান এবং বণ্টন না করেন, তখন তা পৈতৃক সম্পত্তির আওতায় পড়ে। এর ওপর শরিয়াহ
অনুযায়ী উত্তরাধিকারীরা অধিকার রাখেন।
স্ব-অর্জিত সম্পত্তি: এটি দাদার নিজস্ব উপার্জিত সম্পত্তি। শরিয়াহ
অনুসারে দাদা ইচ্ছামতো বণ্টন করতে পারেন বা উইল করতে পারেন। তবে মৃত্যুর পর ওয়ারিশদের
মধ্যেই এটি শরিয়াহ অনুযায়ী বণ্টিত হবে।
এতিম নাতি-নাতনির অবস্থা
ইসলাম এতিমদের অধিকার সুরক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। যদি কোনো শিশু
তার বাবাকে হারায় এবং দাদা জীবিত থাকেন, তাহলে তিনি নৈতিক ও শরিয়াহর দিক থেকে দায়িত্ববান
হন সেই নাতি বা নাতনিকে রক্ষা করার জন্য।
তবে আবারও বলা প্রয়োজন, যদি দাদা কোনো উইল না করেন, এবং আইন অনুযায়ী
৪ ধারা কার্যকর না হয়, তাহলে এতিম নাতি-নাতনিরা দাদার মৃত্যুর পর তার সম্পত্তির স্বাভাবিক
ওয়ারিশ হবে না।
যদি বাবা জীবিত অবস্থায় মারা যান এবং দাদা পরে মৃত্যুবরণ করেন?
এই অবস্থায়, যদি ১৯৬১ সালের পারিবারিক আইনের ৪ ধারা অনুসারে নাতি-নাতনি
জীবিত থাকে, তাহলে তারা সেই সম্পত্তির অংশীদার হতে পারে যেটি তাদের বাবা পেতেন যদি
তিনি জীবিত থাকতেন।
উত্তরাধিকারীদের মধ্যে অংশ বণ্টন কেমন হবে?
দাদার মৃত্যুর পর যদি ওয়ারিশরা হন:
স্ত্রী
জীবিত সন্তান
মৃত সন্তানের সন্তান (নাতি-নাতনি)
পিতা-মাতা (যদি জীবিত)
তাহলে ইসলামী উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী:
স্ত্রী পাবেন নির্ধারিত ১/৮ বা ১/৪ অংশ
ছেলে-মেয়ে থাকলে: ছেলে মেয়ের তুলনায় দ্বিগুণ পায়
নাতি-নাতনি শুধু তখনই পাবে, যখন তাদের পিতা (দাদার সন্তান) দাদার জীবদ্দশায়
মারা গেছেন, এবং ৪ ধারা কার্যকর হয়।
শ্নোত্তর (FAQ)
১. দাদা জীবিত থাকাকালীন বাবা মারা গেলে, নাতি কি ওয়ারিশ হবে?
সরাসরি না। তবে ১৯৬১ সালের আইন অনুযায়ী, দাদার মৃত্যুর পর নাতি তার
বাবার প্রাপ্য অংশ পেতে পারে।
২. দাদা যদি উইল না করেন, তাহলে কি এতিম নাতি কিছুই পাবে না?
যদি ৪ ধারা কার্যকর হয়, তাহলে পাবে। না হলে দাদা উইল না করলে ওয়ারিশ
হবে না।
৩. দাদীর সম্পত্তিতে নাতি বা নাতনির অধিকার আছে কি?
যদি দাদীর মৃত্যুর সময় তার সন্তান (নাতির বাবা বা মা) জীবিত না থাকেন,
তাহলে ৪ ধারা মোতাবেক নাতি বা নাতনি তার অংশ পেতে পারে।
৪. বাবা জীবিত অবস্থায় ছেলে মারা গেলে, সেই ছেলের সন্তানরা কি সম্পত্তি
পাবে?
বাবা জীবিত থাকলে, মারা যাওয়া ছেলের সন্তানরা সরাসরি উত্তরাধিকারী
হবে না। তবে বাবা চাইলে উইল করে দিতে পারেন।
৫. মা মারা গেলে মায়ের সম্পত্তি কে পাবে?
মা মারা গেলে তার সন্তান, স্বামী, পিতা-মাতা (যদি জীবিত থাকে) শরিয়াহ
অনুযায়ী ওয়ারিশ হবে। ছেলে-মেয়েরা এতে অংশীদার।
উপসংহার
মুসলিম উত্তরাধিকার আইন অত্যন্ত কাঠামোবদ্ধ ও ধারাবাহিক একটি প্রক্রিয়া।
দাদা বা নানা জীবিত থাকা অবস্থায় বাবা-মা মারা গেলে, নাতি-নাতনিরা স্বাভাবিকভাবে সম্পত্তির
ওয়ারিশ হয় না। তবে বাংলাদেশে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৪ ধারা তাদের অধিকার
রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনগত আশ্রয়। তাই পরিবারের পরিস্থিতি ও আইনগত অবস্থান বুঝে
প্রয়োজনে আইনজীবীর পরামর্শ গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।