শেরপুর জেলা পরিচিতি: ইতিহাস, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, অর্থনীতি ও পর্যটনের পূর্ণ চিত্র ২০২৫
সূচনা
বাংলাদেশের উত্তরের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জেলাগুলোর মধ্যে শেরপুর
অন্যতম। ঢাকার উত্তরে মাত্র ১৮৩ কিমি দূরত্বে অবস্থিত এই জেলা, এখন ময়মনসিংহ বিভাগের
প্রাণকেন্দ্র। শেরপুরের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, পাহাড়-নদী-বন—সব মিলিয়ে এটি
এক অনন্য পর্যটন ও কৃষিভিত্তিক জনপদ।
ইতিহাস ও ঐতিহ্য
প্রাচীন ও মুঘল যুগ
শেরপুর এক সময় কামরূপ রাজ্যের অংশ ছিল। পরে মুঘল আমলে এটি “দশকাহনিয়া
বাজু” নামে পরিচিত ছিল। গাজী বংশের শের আলী গাজীর নামে জেলার নাম হয় শেরপুর।
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমল
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নানকার আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন—এই জেলার মানুষের
সংগ্রামী চেতনার সাক্ষী। ১৮৯৭-এর ভূমিকম্প বদলে দেয় ব্রহ্মপুত্র নদীর গতিপথ।
মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১
ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী ও সোহাগপুরে সংঘটিত সম্মুখযুদ্ধ ও গণহত্যা শেরপুরের
মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল। শহীদ শাহ মোতাসীম বিল্লাহ খুররম ছিলেন এই জেলার বীর
বিক্রম।
ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য ও জলবায়ু
আয়তন: ১,৩৬৩.৭৬ বর্গ কিমি
সীমানা: উত্তরে মেঘালয় (ভারত), দক্ষিণে জামালপুর ও ময়মনসিংহ
নদ-নদী: কংস, সোমেশ্বরী, ভোগাই, কর্ণঝরা ইত্যাদি
জলবায়ু: বার্ষিক তাপমাত্রা ১২–৩৩.৩ °সে, বৃষ্টিপাত প্রায় ২১৭৪ মিমি
প্রশাসনিক কাঠামো
উপজেলা: ৫টি — শেরপুর সদর, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, নকলা
পৌরসভা: ৪টি
ইউনিয়ন: ৫২টি
গ্রাম: ৬৭৮টি
জনসংখ্যা ও সমাজ
মোট জনসংখ্যা: ২৬.৩৬ লাখ (২০২৩, জাতীয় পুষ্টি জরিপ)
ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী: গারো, হাজং, কোচ, ডালু, রাজবংশী
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: ১৭৪৯ মসজিদ, ৫৮ মন্দির, ২৯ গির্জা, ১৫ মাজার,
১৭৫ ঈদগাহ
অর্থনীতি ও কৃষি
কৃষি পণ্য: ধান, পাট, সরিষা, গম, আলু
ফল: কাঁঠাল, আম, জাম্বুরা, বেল
মৎস্য: দেশি ও বিদেশি প্রজাতির মাছ
অকৃষি শিল্প: ধান চাতাল, বাঁশ/লাকড়ি প্রক্রিয়াজাত, ক্ষুদ্র ব্যবসা
যোগাযোগ ও অবকাঠামো
প্রধান সড়ক: ঢাকা-শেরপুর মহাসড়ক
আঞ্চলিক সড়ক: শ্যামগঞ্জ-ঝিনাইগাতী
নদীপথ: পরিবহণে ব্যবহৃত
উল্লেখযোগ্য প্রকল্প: কাটাখালি ব্রিজ (২০২৪ সালে উদ্বোধন)
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য
শিক্ষা
সরকারি কলেজ: ৩টি
বেসরকারি কলেজ: ১৬টি
মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ১৪৯টি
মাদ্রাসা: ২৯২টি
প্রাথমিক বিদ্যালয়: ৩৫৮টি
প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান: কৃষি প্রশিক্ষণ, নার্সিং, কারিগরি
স্বাস্থ্য
৫০ শয্যার জেলা হাসপাতাল
৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
৫২ পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র
বেসরকারি ক্লিনিক, মিশন হাসপাতাল
পর্যটন ও দর্শনীয় স্থান
প্রকৃতি: গজনী অবকাশ কেন্দ্র, মধুটিলা ইকোপার্ক, রাজার পাহাড়
ঐতিহ্য: গড়জরিপা দুর্গ, আড়াই আনী ও নয়আনী জমিদার বাড়ি
ধর্ম: বারোমারি গীর্জা, মাইসাহেবা জামে মসজিদ, শাহ কামাল মাজার
নতুন আকর্ষণ: নালিতাবাড়ীর রাবার ড্যাম ও অর্কিড পর্যটন কেন্দ্র
সংস্কৃতি, গণমাধ্যম ও ক্রীড়া
সংস্কৃতি: ৯৩টি ক্লাব, ১৫ নাট্যদল, ১৩ সিনেমা হল
পত্রিকা: শেরপুর প্রতিদিন, দশকাহনিয়া
খেলাধুলা: ফুটবল, হাডুডু, ক্রিকেট, লাঠিখেলা
লোকজ সংস্কৃতি: কবিগান, জারি, সারি গান এখনো জীবন্ত
উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব
নিগার সুলতানা জ্যোতি – জাতীয় নারী ক্রিকেটার
মতিয়া চৌধুরী – সাবেক কৃষিমন্ত্রী
মনজুরুল আহসান বুলবুল – সাংবাদিক
রবি নিয়োগী – সাংস্কৃতিক সংগঠক
শেরপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরবগাথা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেরপুর জেলার মুক্তিযোদ্ধারা অসাধারণ
সাহসিকতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন। এই জেলার মাটি
রক্তে রঞ্জিত—যেখানে একাধিক
বীর সন্তান মাতৃভূমির জন্য আত্মোৎসর্গ করেছেন।
শহীদ শাহ মোতাসিম বিল্লাহ খুররম (বীর বিক্রম)
শেরপুর জেলার অন্যতম গর্বিত সন্তান শহীদ শাহ মোতাসিম বিল্লাহ খুররম
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য “বীর বিক্রম” খেতাব লাভ
করেন। তার নেতৃত্ব, আত্মত্যাগ ও সংগ্রাম শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল
অধ্যায়।
কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সি (বীর প্রতীক)
বীর মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল হক মুন্সি শেরপুরের আরেক গর্বিত যোদ্ধা, যিনি
সম্মুখযুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য “বীর প্রতীক” খেতাব লাভ
করেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি নেতৃত্বদানের পাশাপাশি বহু অভিযান পরিচালনা করেন।
শহীদ নাজমুল আহসান
ঝিনাইগাতী উপজেলার এই সাহসী যোদ্ধা শহীদ নাজমুল আহসান শত্রু প্রতিরোধে
প্রান উৎসর্গ করেন। তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ঝিনাইগাতীতে নির্মিত হয়েছে “বীর মুক্তিযোদ্ধা
শহীদ নাজমুল আহসান স্মৃতি পার্ক”।
মো. আবু বকর
শেরপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও প্রখ্যাত আওয়ামী
লীগ নেতা মো. আবু বকর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকা পালন করেন।
নুরুল ইসলাম হিরো
জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আরেক সাবেক কমান্ডার নুরুল ইসলাম হিরো শুধু
একজন যোদ্ধাই নন, বরং একজন ঐতিহ্য সংরক্ষকও। তিনি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণ
ও প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন।
শেরপুর জেলার গৌরবময় কবি ও সাহিত্যিকগণ
শেরপুর জেলার সাহিত্যিক ঐতিহ্য গভীর ও গর্বের। এই মাটি জন্ম দিয়েছে
অনেক প্রতিভাবান কবি ও সাহিত্যিকের, যাঁরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলা সাহিত্যে
রেখেছেন অনন্য অবদান।
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
শেরপুর জেলার সমকালীন একজন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক সাইফুল্লাহ মাহমুদ
দুলাল ১৯৮৫ সালের ৩০শে মে সদর উপজেলার যোগিনীমুড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি মূলত একজন কবি হলেও শিল্প-সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর সৃজনশীলতার
ছাপ রয়েছে।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৭৫টি, যা বাংলা সাহিত্যে এক বিশাল
সংযোজন।
সৈয়দ শামসুল হক
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও লেখক সৈয়দ শামসুল হক শেরপুর
জেলার গর্ব।
তিনি উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গানসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় অবদান
রেখে গেছেন।
তাঁর রচনাসমূহ যেমন “নিষিদ্ধ লোবান”, “পায়ের আওয়াজ
পাওয়া যায়” ও “খেলারাম
খেলে যা” বাংলা সাহিত্যে
অমর হয়ে আছে।
ধরণী ধর দত্ত
শেরপুর জেলার আরেক গুণী কবি ধরণী ধর দত্তের কবিতায় রয়েছে প্রকৃতি,
প্রেম ও সমাজচেতনার মিশেল।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থসমূহ হলো:
প্রেম ও ফুল,কুঙ্কুর,মগের মুল্লুক
যামিনী কিশোর রায়
এই প্রথিতযশা কবি বাংলা সাহিত্যে জীবনঘনিষ্ঠ ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে রয়েছে:
জীবন যাপন,বঙ্গোচ্ছ্বাস
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
সম্ভাবনা
রাবার, আনারস, কাজুবাদাম চাষ
ইকো ট্যুরিজম ও গারো হোমস্টে
ধানের GI সনদ অর্জনের প্রচেষ্টা
চ্যালেঞ্জ
বন উজাড় ও ভাঙন
দক্ষতাভিত্তিক কর্মসংস্থানের অভাব
টেকসই নদী প্রতিরক্ষা প্রয়োজন
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ই-গভর্নেন্স ও ডিজিটাল সেন্টার ১০০% কার্যকর
সবুজ শক্তি: সৌর ও উইন্ড হাইব্রিড বিদ্যুৎ
আইটি ও কারিগরি: প্রস্তাবিত কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়, IT ইনকিউবেটর
স্মার্ট কৃষি: ড্রোন, ব্লকচেইন ট্রেসিং
উপসংহার
শেরপুর আজ শুধুই একটি জেলা নয়, এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সম্ভাবনার
প্রতীক। কৃষি, পর্যটন, শিক্ষা ও প্রযুক্তির সমন্বয়ে এটি হতে পারে একটি “সবুজ-স্মার্ট-স্বনির্ভর”
জেলার রোল মডেল। এখানকার ইতিহাস, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি যেন ডাকে—“খাঁটি সবুজ, খাঁটি বাংলাদেশ—এটাই
শেরপুর।
FAQ (সচরাচর জিজ্ঞাসা)
১. শেরপুর জেলা কোন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত?
বর্তমানে এটি ময়মনসিংহ বিভাগের অংশ (২০১৫ সাল থেকে)।
২. শেরপুরের প্রধান পর্যটন স্থান কী কী?
গজনী অবকাশ কেন্দ্র, মধুটিলা ইকোপার্ক, রাজার পাহাড়, নয়আনী জমিদার
বাড়ি, রাবার ড্যাম ইত্যাদি।
৩. শেরপুরের মূল অর্থনৈতিক খাত কোনটি?
কৃষি (ধান, পাট, আলু), মৎস্য, ও পর্যটন খাত প্রধান।
৪. শেরপুরে কতটি উপজেলা আছে?
মোট ৫টি উপজেলা: শেরপুর সদর, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী, শ্রীবরদী, নকলা।
৫. শেরপুরের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ঘটনা কী?
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযুদ্ধ ও গণহত্যা, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ,
টঙ্ক আন্দোলন।
#শেরপুর জেলার গ্রামের নাম #শেরপুর জেলার গ্রাম কয়টি #শেরপুর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তি #শেরপুর জেলার থানা কয়টি #শেরপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত #শেরপুর জেলার এমপি