ধান চাষের সম্পূর্ণ তথ্য ,আধুনিক পদ্ধতিতে বেশি ফলন পেতে যা জানতেই হবে
সূচনা:
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ, আর ধান হলো আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য।
দেশের প্রায় ৭৫% কৃষক ধান চাষের সাথে সরাসরি জড়িত। আধুনিক প্রযুক্তি ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির
সহায়তায় এখন ধান চাষ আগের চেয়ে অনেক সহজ ও ফলপ্রসূ হয়েছে। এই ব্লগে আমরা ধান চাষের
A to Z অর্থাৎ জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপ বিস্তারিতভাবে
তুলে ধরেছি।
আধুনিক ধান চাষ পদ্ধতি: উচ্চ ফলনের জন্য কার্যকর নির্দেশনা
১. উন্নত জাত নির্বাচন
উচ্চফলনশীল জাত বেছে নিতে হবে:
- BRRI dhan28, 29 (বোরো)
- BRRI dhan75, 87 (আমন)
- BRRI dhan48, 55 (আউশ)
২. মানসম্মত বীজ ও বীজ শোধন
রোগমুক্ত বীজ ব্যবহার করুন।
প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম ভিটাভেক্স ২০০ দিয়ে শোধন করুন।
৩. বীজতলা ও চারা উৎপাদন
বীজতলা আগাছামুক্ত ও সমতল হতে হবে।
চারা ২৫–৩০ দিন বয়সে রোপণের জন্য উপযুক্ত।
৪. সারিবদ্ধ চারা রোপণ (Line Planting)
দূরত্ব: ২০×২০ সেমি বা ২০×১৫ সেমি
প্রতি গর্তে ২টি করে চারা
রোপণ মেশিন ব্যবহার করলে সময় ও শ্রম কম লাগে।
৫. সুষম সার ব্যবস্থাপনা
ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জৈব সার নির্দিষ্ট মাত্রায় প্রয়োগ
করতে হবে।
ইউরিয়া ৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করুন।
৬. সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা
সময়মতো সেচ দিতে হবে।
জলাবদ্ধতা বা খরার ঝুঁকি কমাতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৭. আগাছা, রোগ ও পোকামাকড় দমন
আগাছা নিয়ন্ত্রণে হ্যান্ড উইডিং বা আগাছানাশক ব্যবহার করুন।
নিয়মিত রোগ/পোকার পর্যবেক্ষণ করুন এবং প্রয়োজনে কীটনাশক ব্যবহার করুন।
৮. আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার
ধান রোপণ যন্ত্র, পাওয়ার টিলার, কম্বাইন হারভেস্টার ব্যবহার করলে শ্রম
ও খরচ কমে।
সময় বাঁচে ও ফলন ভালো হয়।
৯. ধান কাটাই ও সংরক্ষণ
শীষ ৮০–৯০% পাকলে কাটুন।
ভালোভাবে শুকিয়ে (১২–১৪% আর্দ্রতা)
সংরক্ষণ করুন।
১০. প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল সহায়তা
কৃষি অফিসের পরামর্শ নিন।
কৃষি অ্যাপ বা SMS সেবার মাধ্যমে তথ্য নিন।
ধান চাষের মৌসুম
ধান সাধারণত তিনটি
মৌসুমে চাষ করা হয়:
মৌসুম |
সময়কাল |
জাতের নাম |
আউশ |
এপ্রিল |
BRRI
dhan48, BRRI dhan55 |
আমন |
জুলাই |
BRRI
dhan49, BRRI dhan75 |
বোরো |
নভেম্বর |
BRRI dhan28,
BRRI dhan29 |
ধান চাষের ধাপসমূহ (A to Z বিস্তারিত)
১. জমি নির্বাচন ও প্রস্তুতি:
উর্বর, সমতল ও পানি নিষ্কাশনযোগ্য জমি নির্বাচন করতে হবে।
জমি চাষের আগে আগাছা পরিষ্কার করুন।
জমিতে ২-৩ বার চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিন।
জৈব সার (গোবর বা কম্পোস্ট) মিশিয়ে নিন।
২. উন্নতমানের ধানের জাত নির্বাচন:
সঠিক জাত নির্বাচন ফলনের অন্যতম মূল চাবিকাঠি। কিছু উচ্চফলনশীল জাত:
- BRRI dhan28 (বোরো) – ৭.৫-৮.৫ টন/হেক্টর
- BRRI dhan49 (আমন) – ৫.৫-৬.৫ টন/হেক্টর
- BRRI dhan48 (আউশ) – ৪.৫-৫ টন/হেক্টর
৩. বীজ শোধন ও চারা উৎপাদন:
প্রতি কেজি বীজে ৩ গ্রাম ভিটাভেক্স ২০০ দিয়ে শোধন করুন।
বীজ ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে রেখে ৪৮ ঘণ্টা জাগ দিন।
বীজতলা প্রস্তুত করে চারা লাগান। (প্রতি শতাংশে ৮-১০ কেজি বীজ প্রয়োজন)
৪. চারা রোপণ:
৩০ দিন বয়সী চারা রোপণ করা ভালো।
সারিবদ্ধ পদ্ধতিতে ২০x২০ সেমি দূরত্ব বজায় রেখে রোপণ করলে পরিচর্যা
সহজ হয়।
৫. সার প্রয়োগ (সুষম সার ব্যবস্থাপনা):
সার প্রয়োগের পরিমাণ (হেক্টরপ্রতি)
ইউরিয়া ২৭০-৩০০ কেজি
টিএসপি ১১০-১২০ কেজি
এমওপি ৯০-১০০ কেজি
জিপসাম ৬০ কেজি
জৈব সার ৫-৭ টন
ইউরিয়া ৩ কিস্তিতে প্রয়োগ করতে হবে: রোপণের ১৫ দিন, ৩০ দিন ও ৫০ দিন
পর।
৬. সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা:
ধান একটি জলাভাস পছন্দ করে, তবে অতিরিক্ত পানি ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বোরো ধানের জন্য ৩-৪ বার সেচ প্রয়োজন হয়।
৭. আগাছা দমন:
রোপণের ১৫-২০ দিন পর আগাছা দমন করুন।
প্রয়োজনে আগাছানাশক ব্যবহার করা যায় (Butachlor, Pretilachlor)
৮. রোগ ও পোকামাকড় দমন:
নিম্নে কিছু সাধারণ রোগ ও প্রতিকার দেওয়া হলো:
রোগ/পোকার নাম-----------লক্ষণ---------- প্রতিকার
ব্লাস্ট রোগ-------পাতা পুড়ে যাওয়া------- ট্রাইসাইক্লাজল স্প্রে
বাদামী দাগ-------পাতায় বাদামী দাগ-------কার্বেন্ডাজিম স্প্রে
কারেন্ট পোকা -------পাতা কেটে
ফেলে-------কার্বোফিউরান প্রয়োগ
মাজরা পোকা-------কাণ্ডে ছিদ্র করে ----- -- BT কীটনাশক ব্যবহার
৯. ধান কাটাই ও মাড়াই:
ধান পাকলে (৮০-৯০% শীষ হলুদ) কাটাই করুন।
কাটার ২-৩ দিন পর রোদে শুকিয়ে মাড়াই করুন।
ভালোভাবে শুকিয়ে (১২-১৪% আর্দ্রতা) সংরক্ষণ করুন।
অধিক ফলনের জন্য করণীয়:
উন্নত জাত ব্যবহার করুন
সুষম সার প্রয়োগ করুন
সঠিক সময়ে পানি ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ
রোগ-পোকা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ
আধুনিক যন্ত্রপাতি (ধান রোপণ যন্ত্র, কম্বাইন হারভেস্টার) ব্যবহার
করুন
কৃষকদের জন্য কিছু আধুনিক টিপস:
এসএমএস/অ্যাপের মাধ্যমে আবহাওয়ার খবর রাখা।
কৃষি অফিসারের পরামর্শ গ্রহণ।
বালাই ব্যবস্থাপনা IPM পদ্ধতি অনুসরণ।
ফসল বিমা গ্রহণ করা।
আমন ধান চাষ পদ্ধতি সংক্ষিপ্ত গাইড
চাষের সময়:
জুলাই থেকে নভেম্বর (বর্ষা মৌসুম)।
জাতের নাম:
BRRI dhan49 – খরা সহনশীল
BRRI dhan75 – বেশি ফলনশীল
BRRI dhan87 – আধুনিক জাত
ধাপসমূহ:
১. জমি প্রস্তুতি:
মাঝারি উঁচু জমি বেছে নিন।
আগাছা পরিষ্কার করে ২-৩ বার চাষ দিন।
২. বীজতলা ও চারা:
প্রতি হেক্টরে ২৫ কেজি বীজ লাগবে।
২৫-৩০ দিন বয়সী চারা লাগান।
৩. চারা রোপণ:
দূরত্ব: ২০x১৫ সেমি
প্রতি গর্তে ২টি করে চারা।
৪. সার ব্যবস্থাপনা (হেক্টরপ্রতি):
ইউরিয়া – ২৮০ কেজি
টিএসপি – ১২০ কেজি
এমওপি – ১০০ কেজি
জৈব সার – ৫ টন
৫. পানি ও আগাছা নিয়ন্ত্রণ:
প্রয়োজন অনুযায়ী পানি দিন।
১৫-২০ দিন পর আগাছা পরিষ্কার করুন।
৬. রোগ/পোকা দমন:
ব্লাস্ট, মাজরা পোকার বিরুদ্ধে কীটনাশক ব্যবহার করুন।
৭. ধান কাটাই:
শীষ ৮০% পাকলে কাটুন।
রোদে শুকিয়ে মাড়াই করুন।
ছোট FAQ:
প্রশ্ন: আমন ধান কবে চাষ হয়?
উত্তর: জুলাই-আগস্ট মাসে।
প্রশ্ন: ভালো জাত কোনটি?
উত্তর: BRRI dhan75।
প্রশ্ন: কতদিনে ধান কাটতে হয়?
উত্তর: ১০০-১২০ দিনে।
আমন ধান কোন ঋতুতে হয়
আমন ধান সাধারণত বর্ষা ঋতুতে চাষ করা হয়।
চাষের সময়: আষাঢ়-শ্রাবণ (জুলাই-আগস্ট) মাসে চারা রোপণ করা হয়।
ফসল ঘরে তোলা হয়: কার্তিক-অগ্রহায়ণ (অক্টোবর-নভেম্বর) মাসে।
অর্থাৎ বর্ষা মৌসুমে আমন ধানের চাষ হয় এবং হেমন্ত ঋতুতে ফসল কাটা হয়।
বোরো ধানে সার প্রয়োগ পদ্ধতি
সার প্রয়োগ পদ্ধতি (প্রতি হেক্টরে):
সার পরিমাণ
ইউরিয়া (Urea) ২৭০–৩০০ কেজি
টিএসপি (TSP) ১১০–১২০ কেজি
এমওপি (MOP) ৯০–১০০ কেজি
জিপসাম ৬০ কেজি
দানাদার জৈব সার ৫–৭ টন
ইউরিয়া প্রয়োগ ধাপভিত্তিক (৩ কিস্তিতে):
প্রথম কিস্তি: চারা রোপণের ১৫ দিন পর
দ্বিতীয় কিস্তি: রোপণের ৩০ দিন পর
তৃতীয় কিস্তি: ধান ফুল আসার আগে (৪৫–৫০ দিন পর)
অন্যান্য সার প্রয়োগ:
টিএসপি, এমওপি ও জিপসাম জমি তৈরি করার সময়ই সম্পূর্ণ প্রয়োগ করুন।
জৈব সার জমি চাষের আগে ভালোভাবে মিশিয়ে দিন।
পরামর্শ:
সার প্রয়োগের পর সেচ দিন।
মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনে সার পরিমাণ সামঞ্জস্য করুন।
সুষম সার ব্যবহারে ধান গাছ সবল হয় এবং ফলন বাড়ে।
ধান চাষে লাভ ও খরচের বিশ্লেষণ (বোরো মৌসুমে)
খরচের খাত পরিমাণ (প্রতি বিঘা)
বীজ----- ৫০০ টাকা
সার----- ১৫০০ টাকা
চারা রোপণ ও মজুরি----- ২০০০
টাকা
সেচ ও ঔষধ----- ১০০০ টাকা
মোট খরচ----- ৫০০০ টাকা
উৎপাদন (মন)----- ২০ মন (গড়)
বিক্রি (২৫০০ টাকা/মন)----- ৫০,০০০
টাকা
লাভ প্রায় ২০,০০০ টাকা/বিঘা
FAQ (প্রশ্নোত্তর):
প্রশ্ন ১: ধান চাষের জন্য সেরা মৌসুম কোনটি?
উত্তর: বোরো মৌসুমে (ডিসেম্বর-মে) ধান চাষে সর্বোচ্চ ফলন পাওয়া যায়।
প্রশ্ন ২: ধানে ব্লাস্ট রোগ হলে কী করব?
উত্তর: দ্রুত ট্রাইসাইক্লাজল বা ট্রিসাইক্লাজল জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে
করুন। রোগমুক্ত জাত ব্যবহার করাও উত্তম।
প্রশ্ন ৩: ধান চাষে জৈব সার কি ব্যবহার করা যায়?
উত্তর: অবশ্যই। জৈব সার মাটির উর্বরতা ও পানি ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
প্রশ্ন ৪: ধান চাষে লাভবান হওয়ার কৌশল কী?
উত্তর: উন্নত জাত, সঠিক সময়ে চাষাবাদ, সুষম সার, রোগ-পোকা দমন, এবং
বাজার বিশ্লেষণই লাভবান হওয়ার মূল কৌশল।
প্রশ্ন ৫: ধান কাটার পর জমিতে কী ফসল চাষ করা যায়?
উত্তর: ধান কাটার পর মুগডাল, সরিষা, গম, ভুট্টা চাষ করা যেতে পারে।
উপসংহার:
ধান চাষ শুধুমাত্র একটি কৃষিকাজ নয়, এটি আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার মূল
ভিত্তি। আধুনিক প্রযুক্তি, সঠিক জ্ঞান ও নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে একজন কৃষক প্রতি বিঘা
জমিতে ২০-২৫ মন পর্যন্ত ধান উৎপাদন করতে পারেন। এই গাইড অনুসরণ করলে আপনি ধান চাষে
সাফল্য লাভ করবেন এবং দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে অবদান রাখতে পারবেন।
কীওয়ার্ড (SEO Keywords):
ধান চাষ, ধান চাষের পদ্ধতি, বোরো ধান, আমন ধান, আউশ ধান, ধান চাষে
লাভ, কৃষি তথ্য, ধান উৎপাদন, কৃষি প্রযুক্তি, আধুনিক ধান চাষ