ওজন বাড়ানোর উপায়, কী খাবেন কীভাবে খাবেন – জেনে নিন স্বাস্থ্যকর গাইডলাইন
ভূমিকা
যেখানে অধিকাংশ মানুষ ওজন কমাতে ব্যস্ত,
সেখানে অনেকেই রয়েছেন যারা বিপরীত সমস্যায় ভোগেন – ওজন না বাড়া। বারবার খাওয়ার পরও
ওজন বাড়ছে না, দুর্বলতা লাগছে, মানসিক হতাশা তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র সমাধান
হলো সঠিক পুষ্টি পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস। চলুন দেখে নেই কীভাবে আপনি স্বাস্থ্যসম্মতভাবে
ওজন বাড়াতে পারেন। (দ্রুত ওজন বৃদ্ধির উপায়)
কেন ওজন বাড়ে না?
ওজন না বাড়ার পেছনে নানা কারণ থাকতে
পারে:
- বংশগত কারণ
- অতিরিক্ত মেটাবলিজম (বিপাক)
- পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব
- সঠিক খাদ্যাভ্যাস না থাকা
- হরমোন সমস্যা বা পেটের কৃমি
- দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ
এই কারণগুলো শনাক্ত করে চিকিৎসকের পরামর্শ
নিয়ে খাদ্য পরিকল্পনা করা জরুরি। (কিভাবে ওজন
বাড়াবো)
ওজন বাড়ানোর সেরা স্বাস্থ্যকর খাবার
দ্রুত ওজন বাড়ে কি খেলে
১. উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার
আপনার ক্যালোরি ইনটেক বাড়ানো ওজন বৃদ্ধির
প্রথম ধাপ। নিচের খাবারগুলোতে রয়েছে প্রচুর ক্যালোরি ও পুষ্টি:
- বাদাম (কাজু, চিনাবাদাম, বাদাম মাখন)
- অ্যাভোকাডো
- ঘি ও মাখন
- সম্পূর্ণ দুধ ও দুধজাত পণ্য
- কুইনোয়া ও ব্রাউন রাইস
২. উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার
ওজন বাড়ানোর সময় প্রোটিন খাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি পেশী গঠনে
সাহায্য করে।
- ডিম
- মুরগির মাংস
- গরুর মাংস (লাল মাংস)
- মাছ (স্যামন, টুনা)
- ডাল, মটর, ছোলা
- গ্রিক দই ও কুটির পনির
৩. স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার
ভালো ফ্যাট আমাদের শক্তির উৎস। এর মাধ্যমে ক্যালোরিও বাড়ে।
- জলপাই তেল, নারকেল তেল
- চিয়া সিড ও ফ্ল্যাক্স সিড
- অ্যাভোকাডো
- ফ্যাটি মাছ
৪. সম্পূর্ণ শস্য ও কার্বোহাইড্রেট
কার্বোহাইড্রেট না খেলে ওজন বাড়বে না। নিচের জটিল কার্বোহাইড্রেট যুক্ত
খাবার খেতে পারেন:
- হোল গ্রেইন রুটি ও পাস্তা
- ওটস ও গ্রানোলা
- মিষ্টি আলু
- লাল চাল বা ব্রাউন রাইস
৫. শুকনো ফল ও ফলমূল
শুকনো ফলে রয়েছে উচ্চ ক্যালোরি ও প্রাকৃতিক চিনি:
স্বাস্থ্যকর গাইডলাইন
- খেজুর, কিশমিশ, এপ্রিকট
- কলা, আম, চেরি
- স্মুদি বা ফলের জুস
সকালে খালি পেটে কি খেলে ওজন বাড়ে
পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুধ – ১ গ্লাস দুধ ওজন বাড়াতে সহায়ক।
কলা – ১–২টি কলা খেলে শক্তি ও ক্যালোরি মেলে।
খেজুর – ৩–৫টি খেজুর সকালে খালি পেটে খান।
বাদাম – ভেজানো কাজু/চিনাবাদাম/আখরোট (৫–১০টি)।
ঘি মেশানো দুধ – ১ চামচ ঘি + দুধ = প্রাকৃতিক ওজন বাড়ানোর পানীয়।
চিড়া-দুধ/মুগ ডাল – হালকা মিষ্টি করে খেলে উপকার পাবেন।
ওজন বৃদ্ধির জন্য একটি স্যাম্পল মিল প্ল্যান
ওজন বৃদ্ধির ডায়েট চার্ট
ব্রেকফাস্ট (সকাল)
- ২-৩টি ডিম + পনির + সবজি দিয়ে অমলেট
- অ্যাভোকাডো টোস্ট বা বাদাম মাখনের টোস্ট
- এক গ্লাস দুধ বা দই
- এক মুঠো বাদাম বা ড্রাই ফ্রুটস
লাঞ্চ (দুপুর)
- ব্রাউন রাইস + গ্রিলড চিকেন/গরুর মাংস
- সবজি সালাদ (অ্যাভোকাডো, টমেটো, ক্যাপসিকাম)
- মিষ্টি দই বা ফল
- ডিনার (রাত)
- ভাজা মাছ/স্যামন + আলু ভাজি
- সবজি ভাজি + ডাল
- রুটি বা হোল গ্রেইন পাস্তা
স্ন্যাকস (মধ্যবর্তী খাবার)
- প্রোটিন বার
- ফলের স্মুদি বা মিল্ক শেক
- বাদাম ও বীজ
কী খাবেন না?
- সফট ড্রিংকস ও কোল্ড ড্রিংক
- ফাস্ট ফুড বা বেশি ভাজাভুজি
- অতিরিক্ত মিষ্টি
- ফ্যাক্টরি প্রক্রিয়াজাত খাবার
এসব খাবারে ক্যালোরি থাকলেও পুষ্টি থাকে না এবং শরীরে ফ্যাট জমিয়ে
দেয়।
ওজন বাড়ানোর জন্য অন্যান্য টিপস
১. নিয়মিত ব্যায়াম করুন
হালকা ওয়েট ট্রেইনিং ও স্কোয়াট জাতীয় ব্যায়াম পেশি গঠনে সাহায্য করে।
২. পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন কমপক্ষে ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
৩. প্রতিদিনের ক্যালোরি গণনা
প্রয়োজনে ক্যালোরি ট্র্যাকার অ্যাপ ব্যবহার করুন।
৪. স্ন্যাকস মিস করবেন না
প্রতিদিন ৫–৬ বার খাওয়ার চেষ্টা করুন। খাওয়ার মাঝখানে হালকা স্বাস্থ্যকর
স্ন্যাকস খুব গুরুত্বপূর্ণ।
কোন ভিটামিন খেলে ওজন বাড়ে?
Vitamin B-Complex – ক্ষুধা বাড়ায় ও হজম শক্তি বাড়ায়
Vitamin D – হরমোন ব্যালান্স ও পেশি তৈরিতে সহায়ক
Vitamin A – প্রোটিন শোষণে সাহায্য করে
Vitamin C – হজমে সহায়তা করে
কখন ব্যায়াম করলে ওজন বাড়ে?
খাওয়ার ১–২ ঘণ্টা পরে ব্যায়াম করুন (বিশেষ করে সকালের দিকে)।
সন্ধ্যায় হালকা খাবার খেয়ে ওয়ার্কআউট করাও ভালো।
ওজন বাড়াতে কোন ধরনের ব্যায়াম করবেন?
ওয়েট ট্রেইনিং (Weight Training) – পেশি বাড়াতে সাহায্য করে
বডি রেসিস্ট্যান্স এক্সারসাইজ – পুশ-আপ, স্কোয়াট, চেয়ার ডিপ
কম পরিমাণ কার্ডিও – অল্প হাঁটা বা জগিং (অনেক করলে ওজন কমে)
টিপস:
ব্যায়ামের আগে ও পরে প্রোটিন বা দুধ খান
সপ্তাহে ৩–৫ দিন ব্যায়াম করুন
পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন
ওজন বাড়াতে চাইলে ওজন তুলে ব্যায়াম করুন এবং সকাল বা বিকেলে খাওয়ার
কিছুক্ষণ পর ব্যায়াম করাই সবচেয়ে ভালো।
কোন সিরাপ খেলে ওজন বাড়ে
ওজন বাড়ানোর জন্য কিছু সিরাপ বাজারে পাওয়া যায় যা ক্ষুধা বাড়ায় এবং
পুষ্টি শোষণ ভালো করে। তবে এগুলো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘদিন খাওয়া ঠিক নয়। নিচে
কিছু জনপ্রিয় ওজন বৃদ্ধিকারী সিরাপের নাম ও তথ্য সংক্ষেপে দেওয়া হলো:
কোন সিরাপ খেলে ওজন বাড়ে?
সিরাপের নাম |
কাজ |
ব্যবহার |
Apetamin |
ক্ষুধা বাড়ায়,
ওজন বাড়ায় |
দিনে ২–৩ বার
খাবারের আগে |
Cypon Syrup |
ক্ষুধা ও হজম
শক্তি বাড়ায় |
দিনে ২ বার |
Tres Orix
Forte |
পুষ্টি শোষণ
বাড়ায়, শক্তি দেয় |
দিনে ১–২ বার |
Becosules
Syrup |
ভিটামিন
B-complex সরবরাহ করে |
চিকিৎসকের পরামর্শে |
Zincovit
Syrup |
ভিটামিন ও মিনারেল
সাপোর্ট দেয় |
শিশু ও বড়দের
জন্য |
সতর্কতা:
অনেক সিরাপের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকতে পারে (ঘুম, ক্লান্তি, অতি ক্ষুধা)
ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার ঝুঁকিপূর্ণ
গর্ভবতী, ডায়াবেটিক বা হরমোন সমস্যায় ভোগা ব্যক্তিদের জন্য সাবধানতা
জরুরি
ওজন বাড়াতে Apetamin, Cypon বা Tres Orix Forte সিরাপ বেশ জনপ্রিয়,
তবে ব্যবহারের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অস্বাস্থ্যকর ওজন বৃদ্ধি ও ঝুঁকি
অতিরিক্ত ক্যালোরি নিতে গিয়ে অনেকে অস্বাস্থ্যকরভাবে ওজন বাড়িয়ে ফেলেন,
যা বিপদ ডেকে আনতে পারে:
- স্থূলতা ও ডায়াবেটিস
- উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ
- মানসিক অবসাদ ও আত্মবিশ্বাস হ্রাস
- হজমের সমস্যা ও গ্যাস্ট্রিক
- ঘুমের সমস্যা (স্লিপ অ্যাপনিয়া)
- হরমোন ভারসাম্যহীনতা
এই ঝুঁকি এড়াতে স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নিতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ
নিতে হবে।
উপসংহার
ওজন বাড়ানো মানে শুধু বেশি খাওয়াই নয়, বরং সঠিকভাবে ও সুষমভাবে খাওয়া।
উচ্চ ক্যালোরি, প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার খেলে ধীরে ধীরে ওজন বাড়বে,
এবং সেই ওজন থাকবে সুস্থভাবে। প্রয়োজনে একজন ডায়েটিশিয়ানের সাহায্য নিয়ে নিজস্ব খাদ্য
তালিকা তৈরি করা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
প্রতিদিন ধৈর্য ধরে খাবার খেতে হবে, শরীরকে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিতে
হবে, এবং ইতিবাচক মনোভাব রাখতে হবে। তাহলেই আপনি সুস্থভাবে ওজন বাড়াতে পারবেন।
ওজন বাড়ানো নিয়ে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
১. দিনে কতবার খাওয়া উচিত ওজন বাড়ানোর জন্য?
উত্তর: অন্তত ৫-৬ বার খাওয়া উচিত – তিনটি বড় মিল এবং ২-৩টি স্ন্যাকস।
এতে শরীর পর্যাপ্ত ক্যালোরি পায়।
২. কোন দুধ ওজন বাড়াতে সাহায্য করে?
উত্তর: পূর্ণ চর্বিযুক্ত দুধ (Full-fat milk) ওজন বাড়াতে সবচেয়ে উপযোগী।
৩. রাতে দুধ খেলে কি ওজন বাড়ে?
উত্তর: হ্যাঁ, রাতে দুধ খেলে অতিরিক্ত ক্যালোরি পাওয়া যায়, যা ওজন
বৃদ্ধিতে সহায়ক।
৪. কেবল ফল খেলে কি ওজন বাড়বে?
উত্তর: শুধু ফল খেলে ওজন বাড়বে না, কারণ এতে ক্যালোরি কম থাকে। তবে
শুকনো ফল এবং মিল্ক শেক সহকারে ফল খেলে উপকার পাওয়া যায়।
৫. কতদিনে ওজন বাড়তে শুরু করে?
উত্তর: যদি আপনি প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩০০-৫০০ ক্যালোরি খান এবং নিয়ম
মেনে চলেন, তবে ২–৩ সপ্তাহের মধ্যেই পরিবর্তন দেখতে পাবেন।